রজকিনী প্রেম

রজকিনী প্রেম কালের সীমা পেরিয়ে এক অনন্য ভালোবাসা

 

রজকিনী প্রেম। কলকাতা শহর থেকে 50 মাইলের মধ্যে ঘটনাস্থান। আমি জায়গাটার নাম বলতে চাই না। জায়গাটা শহর শিল্পাঞ্চলে মফস্বল শহর যে রকম হয়ে থাকে সেই রকমটা। আমার পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় একটু দূরে একটি পরিবারে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে। অবসর সময় প্রায়ই যাই। যাবার ছোটখাটো আকর্ষণ আমাদের খিঞ্জি পাড়া থেকে সেই পাড়াটি এখনও বেশ খোলামেলা। খোলা মাঠ গাছপালা আশপাশে কয়েকটা পুকুর। সকালে সন্ধ্যায় গাছতলায় বসে গল্প গুজবও করা যায়। অনেকদিনই দেখেছি একটি পুকুরে চার পাঁচটি পাট এবং একটি রজব পরিবার সেই পুকুরে কাপড় কাঁচে। একটি পরিবার বুঝতে পারি মহিলা পুরুষদের সকলের নীলা মেশা দেখে। যদি পুরোপুরি একটি পরিবার নাও হয়, তারা যে একই গোষ্ঠীভুক্ত পরিবার সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 

 

কাপড় কাচার ব্যাপারে পুরুষ আর একটু বেশি বয়স্কা মহিলাদেরই দেখেছি। অন্যান্য মেয়েরা যারা তরুণী বা কিশোরী তাদের কাজ কাপড় মেলে দেওয়া, শোকানো তোলা নানান ফায়ফরমাসখাটা বাড়ি বা দোকান থেকে এটা সেটা নিয়ে আসা। এরা অবাঙালি কিন্তু অবাঙালিত্বের আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। বাংলায় কথা বলে বাঙালির মতোই বেশভূষা আচার আচরণ।আবার অনেক অবাঙালি রজক পরিবার দেখেছি। তারা কিন্তু অন্যরকম পেশা এক হলেও তাদের আচার আচরণ, জীবন যাপন ভিন্নরকম। কিছুটা স্থূল অমার্জিত। আমি যাঁদের কথা বলছি তারা নিঃসন্দেহে তথাকথিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বাঙালিদের মতো নয় কিছুটা গ্রাম্যতা অবশ্যই আছে এবং তাদের এক বৃদ্ধাকে দেখি গাছতলায় বসে বসে শিশুদের সামলায় আর ফুকফুক করে বিড়ি টানে।

 

 এই বৃদ্ধা সম্পর্কে প্রায় কিংবদন্তির মতো একটি কাহিনী সকলেই শুনেছে। কাছেই মুকুট যে পাড়া মুকুজেরা এক কালের সম্পন্ন জমিদার ছিল। এখনও মুখোজেদের পুরো ভিটার ছড়াছড়ি। ধসে পড়া ভূতুড়ে জনমানবহীন ইমারত জড়িয়ে অশুদ্ধ মাথাচাড়া দিয়েছে। মুকুজে পাড়া বললে এখনও মুখোয্যে দেরি বোঝায়। অনেকে কালের প্রবাহে অন্যত্র ভেঙে গেলেও অধস্তন বংশধরদের অনেকেই এখন নতুন বাড়ি করেছে। ব্যবসা, চাকরি সবই করে কারও অবস্থা খারাপ কারও ভালো। বৃদ্ধা রজকিনীর নাম উত্তমা। শোনা যায়, মুকুচে পরিবারের এক পুরুষ রতন মুখুচ্ছে অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার প্রতিপত্তিও ছিল বিস্তৃত। 

 

ব্রিটিশ সরকারের জেলা অফিসার আমলা, পুলিশ মিল কল কারখানা সাহেব সকলের সঙ্গে তাঁর ওঠা বসা ছিল। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন একাধিকবার। রতন মুখার্জির বয়স যখন 40 ঊর্ধ্বে, তখন উত্তমা বয়স 1617। স্বামীর নাম গোবিন্দ। এই অঞ্চলের বাইরে রেললাইন ঘেঁষে রতন মুখোজের হিংসায় পুকুর ছিল। উত্তমা, শ্বশুর রতন মুখুয্যের কাছে সেই পুকুরে কাপড় কাচার অনুমতি চেয়েছিলেন। শ্বশুরের সঙ্গে পুত্র আর পুত্রবধূ ছিল। উত্তমাকে দেখি রতন মুখুয্যের মনে হয়েছিল উত্তম আনা তিলোত্তমা। উত্তমতার সামনেই ঘোমটা। তিনি জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়নি। বাঙালি ছাদে সস্তা দূরে শাড়ি পরা বউটি সমীহ দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। 

 

রতন মুখুচে মদ্যপ ছিলেন। স্ত্রীলোক সম্পর্কে তাঁর দুর্বলতার কথা কখনও শোনা যায়নি। যদিও মুখার্জীদের অনেক পুরুষেরই সেই দুর্বলতা বিলক্ষণ ছিল। যে কারণে মুখোজে পাড়ার কাছেই পারিবারিক বেশ্যালয় তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং এখনও তা আছে। অবশ্যি তাঁর পারিবারিক বলা চলে না। মুখোজেদের বর্তমান বংশধররা সেই দিকে তাকিয়েও দেখেন না। রতন মুখু যে দিন ঘন গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী কোন লগ্নে উত্তমা রজকিনিকে দেখেছিলেন সে কথা কেউ বলতে পারে না। 

 

কিন্তু উত্তমাকে দেখামাত্রই তাঁর সমস্ত জীবনের রং বদলিয়ে গিয়েছিল। রজতীর কাপড় কাঁচা পুকুরে মাছ রক্ষা করা কঠিন জলও নষ্ট হয়ে যায়। রতন মুখুজি তথাপি উত্তমাদের কাপড় কাচার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু রেল লাইনে সেই পুকুরে নয়। কারণ সেটা অনেক দূরে। তিনি তার পাড়ার কাছেই এই বর্তমান পুকুরে কাপড় কাচার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তার জন্য কোনও কর বা মূল্য ধার্য ছিল না। কিছুকালের মধ্যেই রতন মুখুচ্ছে আর উত্তম আর ব্যাপার আর সোনার পর্যায় ছিল না। ঘটনা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল। রতন মুখু যে উত্তমাকে মুখুচে পাড়া সীমানার মধ্যেই জমি দিয়েছিলেন। পাকা দেওয়ালের উপর টালির ঘর তুলে দিয়েছিলেন এবং বর্তমানে পুকুরটি ছাড়াও অন্য একটি পুকুরেও কাপড় কাঁচা লিখিত অনুমতি দিয়েছিলেন। বর্তমান পুকুরটি উত্তমাকেই দানপত্র করে লিখে দেওয়া আছে। উত্তমার স্বামী শ্বশুর ব্যাপারটাকে কীভাবে নিয়েছিল জানা নেই। কিন্তু কোনও গোলযোগের সংবাদ ছিল না। রতন মুখুঝ্জে নিজেই যেতেনিত তোমার গৃহে। নিজের গৃহে বা অন্য কোথাও আলাদা করে রাখেননি। উত্তম আ। কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ি স্বামীর সঙ্গে বরাবর কাপড় কেচেছে। পেশা কখনোই ত্যাগ করেনি। ঢাকায় শাড়ির সঙ্গে সামান্য কিছু অলঙ্কারে উত্তমাকে তিলত্তমায় দেখাত। সে খাটে এসে দাঁড়ালে বয়স্ক পুরুষ বা ছিলে ছোকরাদের ঘোরাঘুরি একটু বেড়ে যেত। তিলোত্তমার তাতে কিচ্ছু আস্ত যেত না। 

 

সে বছরের পর বছর কাপড় কেঁচেছে। সন্তানদের জন্ম দিয়েছে তাঁর সন্তান দের মধ্যে কোনটি কার সে প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু তাকে কখনও রক্ষিতা বা সৈদিনী বলে মনে হতো না। লোকে বলত রতন মুখুঝের ধোঁপানি বিবি। পরবর্তীকালে রতন মুখু ছেলেরা পুকুরের অধিকার নিয়ে কোটকাছাড়িও করেছিলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। রতন মুখুচে ব্যবস্থা পাকাপাকি করে গিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর আগে সব জ্ঞানে একবার উত্তমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। ছেলেরা রাজি ছিলেন না। কিন্তু রতন মুখার্জির স্ত্রী রাজি ছিলেন। তিনি স্বামীর অন্তিম ইচ্ছা পূর্ণ করেছিলেন। দীর্ঘজীবি রতন মুখু 85 বছর বয়সে মারা যান। 

 

উত্তমা তখন আটা ঠাকুমা দিদিমা হয়ে গিয়েছে। সেই বৃদ্ধা উত্তমা এখন সত্তরের ঊর্ধ্বে বিধবা। বিড়ির নেশাটা সে কবে থেকে ধরেছে কে জানে। তবে শুনেছি কখনও কেউ তার বেচাল দেখেনি। বাঁচা লতাও দেখেনি বরং শরীরের রূপ আর যৌবনের ঢল নিয়েও তার পরিশ্রমী জীবনের মধ্যে বিশেষ ব্যক্তিত্ব ছিল। তাঁর আচার আচরণের মধ্যে ছিল সম্ভ্রান্ত ভাব। আড়ালে যে যাই বলুক সামনে দাঁড়িয়ে কোনোদিন কেউ একটিও বাজে কথা বলতে পারেনি। এখন আমরা দেখলে বুঝতে পারি কর্তব্যরত এই সব রজব পরিবারের মহিলা পুরুষদের সেই সর্বময়ী কর্তৃক।প্রায় দেখি আশপাশের সমস্ত বাড়ি মহিলাদের সঙ্গে এরা কাজের ফাঁকে কথা বলে গল্প করে বাড়ির ভিতরেও যাতায়াত আছে। 

 

এখনকার চেহারা আলাদা। তরুণী মেয়েরা যারা পুকুরে নানান কাজে আসে তারা বেনি দুলিয়ে কুঁচিয়ে শাড়ি পড়ে। দুই একজনের হাতে ঘড়িও দেখেছি। অবসর সময় গাছতলায় বসে পত্রপত্রিকাও পড়ে। 18 19 বছরের একটি মেয়েকে একদিন অতি আধুনিক লেখকের বইও পড়তে দেখেছি এবং অবাক হয়েছি।পরে শুনেছি ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ স্কুল কলেজেও পড়ে।আমার বিষয়টা সেখানে।স্কুল কলেজে পড়াটা আশ্চর্য না। কিন্তু বংশগত এই জীবিকার সঙ্গে পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া রীতিমতো বিস্ময়কর। ছেলেবেলায় হেমন্ত দিদিকে স্কুলে যেতে দেখেছি।কিন্তু কর্মক্ষেত্র পুকুরপাড়ের গাছতলায়। কাজের ফাঁকে বেণী দুলিয়ে পা ছড়িয়ে বসে রঙিন ম্যাগাজিন পড়তে দেখিনি। সমস্ত ছবিটা কি মনের মধ্যে 

রোমান্টিক ভাবনা এনে দেয় না। 

 

প্রশ্নটা নিতান্ত বাহুল্য হয়ে গেল। আমার মূল গানটা সেখানেই। কালোক্রমে এই পুকুরের নাম হয়ে গিয়েছে। উত্তমা, পুকুর এবং উত্তমা। পুকুরের ধারে যেসব দিনে উত্তমা পরিবার ভাটিতে আসে সেইসব দিন অনেক ভোমরা আশপাশে গুনগুন করে। সেই সব ভোমরাদের মধ্যে মুকুচে বাড়ির ছেলেরাও আছে এবং ভোমরা ডানা কাঁপানো গুনগুনানি নিঃসন্দেহে রোমান্সেরই সন্ধানে। রোমাসের সর্ববিধ ধারালো অস্ত্র যে শোজ্জিত সে হল উত্তমার বড় ছেলে ছোট কন্যাটি শরীরের গঠনেই রূপে সব দিক থেকেই সে তার পিতামহীকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ও তোমার নিজের চেষ্টা কর না। এখন বয়স চল্লিশের মতো সেও কৈশোরের রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তার বিয়ে হয়।

 

 শহরের বিখ্যাত সেন পরিবারের একটি ছেলের সঙ্গে।স্বাভাবিকভাবে বিয়ে হতে পারেনি। কলকাতায় গিয়ে বিয়ে হয়েছিল এবং সেনবাড়ির সেই ছেলে আর কখনওই নিজের পরিবারে ফিরে আসতে পারেনি। চিরদিনের জন্য কলকাতাবাসী হয়ে গিয়েছে। সেই চেষ্টা কন্যার নাম পূর্ণিমা। রতন মুখুচের ছাপ ছিল তাঁর চেহারা স্পষ্ট। উত্তমা পরিবারকে ঘিরে গুণগুনানি কখনওই একেবারে স্তব্ধ হয়নি। কিন্তু উত্তমা আর পূর্ণিমার পরে সেরকম আলোড়ন তোলার মতো ঘটনা ঘটেনি।ইদানীং মনে হচ্ছে সেরকম ঘটনা আবার আসন্ন হয়ে উঠেছে।এবারকার মধুচক্রও গড়ে উঠেছে যাকে নিয়ে ওর নাম সন্ধ্যা, সন্ধ্যা মণি। নামটা সন্ধামণি বটে। হয়তো সন্ধ্যা লগ্নে জন্মেছিল এবং কৃষ্ণকলি ফুলকেও কেউ কেউ সন্ধ্যামণি বলেও ডাকি। কারণ কৃষ্ণকলি সন্ধ্যা কালেই ফোটে। কিন্তু সন্ধ্যা মণির গায়ের রংকে দুপুরে রং বলা যায়। যা উত্তমার ছিল। কিন্তু উত্তমার তুলনায় সন্ধ্যার আয়ত চোখের টান উন্নত নাসা দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট কিছু কিছু রতন মুখুজ্জির কথা মনে করিয়ে দেয়। সন্ধ্যা সম্প্রতি স্কুল ফাইনাল পাশ করে এই শহরেরই কলেজে প্রি ইউনিভার্সিটি শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। অতএব কেবলমাত্র উত্তম আপুকুরে ধারেই নয়, সন্ধ্যা এখন গোটা শহরের ভোমরাদের পাখার ঝাপটায় বিলোলিত। না সন্ধ্যাকে ঠিক বিলোলিত বলা যাবে না। ওর কোনও চাঞ্চল্য দেখা যায় না। ওর চোখের দৃষ্টি অনেকটা দা ভেঞ্চি লুকরেশিয়ার মতো। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা মোনালিসের ছবি মনে জাগিয়ে তোলে। মনের ঝাপটা অস্পষ্ট হাসিতে প্রতিবিম্বিত হয় না। বাঁশের সঙ্গে টাঙানো দড়িতে ও যখন জামাকাপড় মেলে দেয়। বাতাসে ওরা আঁচল আর চুল ওড়ে। তখন ষাটের ঊর্ধ্বে সুদঘর রসিক মিত্তির সেই দিকে তাকিয়ে উদ্যমাকে বলে কেমন আছো গো উত্তমা ঠাকরুন। উত্তমা বলে ওই আছি। আর কি ঘাটের পথে পা বাড়িয়ে। ভুলো রসিক মিত্তিরই যদি এমন অসুস্থ হয়ে উঠতে পারে তাহলে আর জামরুল গাছের তলা থেকে জওয়ান ছেলের ভরাট গলায় কেন গান শোনা যাবে না। বিধি দাগড়ো আখি যদি দিয়েছিলে সে কি আমারই তরে?

 

কিন্তু সন্ধ্যামণি ঠোঁটের কোণের হাসি যতই অর্থপূর্ণ। অথচ অস্পষ্ট হোক একদিন ঘোর দুপুরে আমি ওকে দেখলাম। উত্তমাপুকুর থেকে একটু দূরে খড়ির পুরো নামক জঙ্গলের দিকে যেতে।যাওয়ার ভঙ্গিতে ছিল ভয়, ত্রস্ত ভাব এবং দ্রুতগতি। চোখে মুখেও ত্রষ্ট ভাবটা লক্ষণীয়। কেমন যেন সন্দেহজনক। ওকে আমার অনুসরণ করার কিছু ছিল না। কিন্তু যা চোখে পড়বার ঠিকই পড়েছিল। হরি পুরো জঙ্গলের ঝাড়ল ছাতির মাছের নিচে নায়কটিকে দেখতে পেয়েছিলাম। নায়কটি আর কেউ না রতন মুখুর্জের চতুর্থ পুত্রেই কনিষ্ঠতম সন্তান শ্যামল। শ্যামলকে চিনি কলেজে পড়ে স্কুটারে করে ঘোরে শহরের নানান অনুষ্ঠানে গিটার বাজায় গালপাট্টা জুল পি আর চুলেও গোঁফে এবং পোশাকে আশাকে যাকে বলে পুরোপুরি মঠ ঝোঁকরা। রজকিণী সন্ধ্যা মণি তাহলে পিতা মহি উত্তমার উত্তরসূরী হতে চলেছে।তিন পুরুষের ফেরতায় আবার সেই মুখার্জি বংশেরই আবর্ত। ব্যাপারটা জানাজানি হতে বিলম্ব হল না। কিন্তু যেটা আশা করিনি, এক্ষেত্রে সেটাই ঘটল। স্বয়ং উত্তমা এই প্রেমের ঘোর বিরোধী।ও যে পরিবারের তো কোনও প্রশ্নই নেই। উত্তমা তার পুকুর ধারে ঘাটে স্পষ্টই বলে দিল। নাতনি কেটে গঙ্গায় ভাসাব তবু এমন পাপ ঘটতে দেব না। পাপ কিসের?

 

তাও উত্তমা জানিয়ে দিল। মুখুয্যে বাড়ির কোনও ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমার কোনও ছেলেমেয়ে নাতি নাতনির বিয়ে হতে পারে না। রক্তে আমি পাপ ঢোকাতে পারব না। অথবা ওর পুকুর ধারে ভাটিতে সন্ধ্যার আশা বন্ধ হয়ে গেল।অতএব ঘটনা চলে গেল নেপথ্যে আমাদের চোখের আড়ালে। লোকমুখে শোনা গেল শ্যামল বাড়িতে বিদ্রোহ করেছে। পুরস্কার জানিয়ে দিয়েছে, সন্ধ্যা কে বিয়ে ও করবে। বাড়ির পরোয়া করে না। উত্তমা বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাকে নাকি উত্তমা পুকুরে ডুবিয়ে মারবে। তার জবাবে উত্তমা পুকুর ধারে দাঁড়িয়েই বলেছে। অমন ছেলেকে আমি পার্টি আছড়ে মারবো ও যেন ভুলে না যায় আমি কি?

 

ব্যাপার যখন এই রকম চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং উত্তেজনা চরমে, তখনই নাটকের শেষ অঙ্ক নেপথ্যে শেষ হয়ে গেল। অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খেয়ে সন্ধ্যামণি আত্মনাশ করেছে  এবং একটি চিঠি সে লিখে রেখে গিয়েছে।মরা ছাড়া আমার আর উপায় নেই।ঠাকমা বলে শ্যামলের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া পাপ।আমি পাপ পণ্য বুঝি না। শ্যামল ছাড়া কারওকেই আমি চাই না। তবে আমি কেন বেঁচে থাকব?

 

আমি মরলাম। তার জন্য কেউ দায়ী নয়। পুলিশ তথাপি মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠাল।এবং আত্মহত্যা প্রমাণিত হল।শহরে বাবরি চুল উড়িয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে শ্যামলকে আর স্কুটার চালিয়ে ঘুরতে দেখা গেল না।শোনা গেল রজকিণী প্রেম তাকে দেশান্তরী করেছে। ভাঁটি দিনে কুকুর ধারে গাছতলায় এখনও উত্তম আবৃদ্ধাকে দেখা যায়।বয়স বোধায় আশির উপরে হল। চোখে ছানি পড়েছে ভালো দেখতে পায় না। বিড়ি টানে বসে বসে শিশুদেরও তেমন আগলাতে পারে না। কিন্তু তার ছানি পরা চোখ যখন দূরে এর আকাশে নিবদ্ধ থাকে  মনে হয়। সেখানে কালের ছবি নানা রূপে খেলছে। মাঝে মাঝে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে শোনা যায়।কী করব? 

 

সে যে মহাপাপ হতো। তুমি তো জানো। তুমি তো সবই জানো হে। তুমি তো জানো। কবি চণ্ডীদাস ভরৎ রাজকত্রের ব্রাহ্মণ ছিলেন কি না জানি না। সম্ভবত তাই ছিলেন। এটা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল কিনা তাও জানি না। কিন্তু মনে হয়। শ্যামল আর সন্ধ্যা যেন সেই পুনরাবৃত্তিরই ঘটনা। সন্ধ্যা আত্মহত্যা করেই। যেন সেটা বিশেষ ভাবে প্রমাণ করে গেল। সমরেশ বসু লেখা রজতিনী প্রেম। ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top